দেশ ও দেশের মানুষ এক চরম সংকটময় মূহুর্তের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। চাইলেও এর থেকে পরিত্রান মিলছে না। বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের কারণে বাংলাদেশ এখন কার্যত অচল। সেই সঙ্গে কর্মহীন হয়ে পড়েছে দিনমজুরসহ দেশের সাধারণ মানুষ। একদিন কাজ না করলে এদের ঘরে আগুন জ্বলে না, না খেয়েই থাকতে হয় পরিবার নিয়ে। সরকারিভাবে বা বেসরকারিভাবে সহায়তা প্রদান করছেন অনেকেই। চাহিদার তুলনায় নগন্য হলেও বেসরকারিভাবে কিছুটা সুষ্ঠু বণ্টন হয়েছে অপরদিকে সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও সরকারিভাবে সহায়তা নিয়ে ববরাবরই কিছু অমানুষ তাদের স্বার্থ উদ্ধারে লুটেপুটে খাচ্ছে এসকল অসহায় অনাহারদের খবারগুলো।
চালচুরি, গমচুরি, তেলচুরি আর কম্বলচুরির ঘটনা খুজলে অহরহই পাওয়া সম্ভব এ দেশে। তাই বলে এই দুর্দিনে অনাহারে থাকা মানুষগুলোর ত্রাণ চুরি। জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে আফসোস করে বলেছিলেন “সাত কোটি বাঙালির আট কোটি কম্বল আমারটা গেল কই?”
সময় বদলেছে ১৯৭৩ থেকে আজ ২০২০ এরপরেও সেই অমানুষগুলো মানুষ হতে পারেনি। এরা অসহায় দুস্থ মানুষদের রক্ত চুষে খেয়েই যাচ্ছে। ত্রাণের জন্য বরাদ্দ দেওয়া চাল, ত্রাণের দেয়া অসহায় মানুষদের অনাহারের অন্ন লুটেপুটে নিতেই হবে।
কয়েকটি পত্রিকার সাম্প্রতিক শিরোনাম দিয়ে আমরা ত্রানচুরির সাম্যক ধারণা পেতে পারি। ‘ত্রাণের চালে রাক্ষুসে থাবা’ (যুগান্তর); ‘ত্রাণ চুরি বন্ধে পুলিশকে কঠোর নির্দেশনা’ (কালের কণ্ঠ); ‘হতদরিদ্রদের চাল চুরি-কাঙালের ধনেও থাবা’ (সমকাল); ‘চাল চুরির হিড়িক’ (ইনকিলাব), ‘চালের গাড়ি যাচ্ছিল স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতার গোডাউন থেকে আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে’ (মানবজমিন); ‘করোনাতেও ২২২৪ বস্তা সরকারি ত্রাণের চাল চুরি’ (কালের কণ্ঠ); ‘সরকারি ত্রাণ ক্ষমতাসীনদের বাড়িতে: রিজভি’ (প্রথম আলো); ‘নয়-ছয় তদন্তের পাঁয়তারা’ (ইনকিলাব); ‘লালমোহনে ইউপি সদস্যের ঘরের মাটি খুঁড়ে চাল উদ্ধার করল পুলিশ’ (মানবজমিন); ‘খাগড়াছড়িতে ২৮ বস্তা চালসহ আটক ১’ (মানবজমিন); ‘ত্রাণের টাকা আত্মসাৎ, হটলাইন অকার্যকর’ (সমকাল); ‘শিবচরে একশ’ বস্তা চালসহ সহযোগী আটক, পালাল আওয়ামী লীগ নেতা’ (মানবজমিন); ‘বিভিন্ন স্থানে ৭ জনকে সাজা, আটক ১০: আরও ৮০০ বস্তা চাল জব্দ’ (যুগান্তর); ‘ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম, দুর্নীতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করবে দুদক’ (মানবজমিন); ‘গরিবের ত্রাণের চাল আত্মসাৎ করেছেন আওয়ামী লীগের নেতারা, ব্যবস্থা কী?’ (কালের কণ্ঠ)। এসব শিরোনাম ব্যাখ্যা না করলেও বোধগম্য। এভাবে অন্যান্য পত্রিকার শিরোনাম উপস্থাপন করলে অন্য কিছু লেখার জায়গা থাকবে না।
দুর্নীতি আর ত্রাণ চুরি নিয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক দুর্নাম আছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বাৎসরিক দুর্নীতির ধারণা সূচকে পাঁচবারের চ্যাম্পিয়ন দেশে হঠাৎ করে দুর্নীতি কমে যাওয়া প্রত্যাশিত নয়। তবে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে যে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, সে সত্য স্বীকার্য। হংকং, সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া এ ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
এ কারণে এখন দুস্থ মানুষের ত্রাণ নিয়ে যে দুর্নীতি হচ্ছে, তা সরকারি নির্দেশনায় কমছে না। যে পুলিশ, যে প্রশাসন ও যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব চাল চুরির বিষয়ে দুর্নীতিবাজদের হুমকি দিচ্ছেন, তারা তো আগে রাজনৈতিক ও নির্বাচনী দুর্নীতি করতে এদের বাধা দেননি।
দেশের এ প্রাদুর্ভাবে অসহায়দের দেয়া সরকারি ত্রাণ চুরির মহা উৎসব দেখা যাচ্ছে পত্রিকার পাতা খুল্লেই। সরকারের কঠোর অবস্থানের মধ্যেও অসহায়দের ত্রাণ চুরি থামছেনা। বিবেকহীনতা এতটাই নিচে নেমে গিয়েছে যে কারো মুখের এক বেলার খাবারটা থাবা মেরে নিতেও একটিবার বুক কাপেনি সরকারী দলের নেতাকর্মীদের। গরীবের ত্রাণ চুরি করে যারা তারা মানুষ নামের কলংক।
একদিকে যেমন ত্রানচোর আছে আবার আরেকদিকে অনেকেই নিজের স্বার্থ বিলীন করে অনাহারদের মুখে একমুঠো খাবার তুলে দিচ্ছেন আর তার মধ্যেই খুজে পাচ্ছেন আত্মতুষ্টি। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সরকারের ত্রাণকার্যক্রমে যারা সাহায্য সহযোগিতা করে সুষ্ঠু বন্টনের মাধ্যমে পৌছে দিচ্ছে দুস্থ মানুষের কাছে তাদের জন্য বিনম্র শ্রদ্ধা। আমাদের উচিৎ এসময় ত্রাণ চুরির মতো জঘন্য কাজ করা মানুষরূপী অমানুষগুলোকে প্রতিহত করে শোনার বাংলার অসহায় মানুষদের পাশে দাড়িয়ে সুখ-দুঃখের ভাগীদার হওয়া।